আমার সন্তান যেন থাকে মাছে-ভাতে

This page in:

 

Image
A mother feeds her daughter in Bangladesh. Image courtesy: The World Bank


বাঙালির  চিরন্তন প্রার্থনা তার সন্তানের মুখে একটু মাছ তুলে দেয়া।  প্রকৃতির দাক্ষিণ্যে বাংলাদেশে ধান, ফল, আর মাছের অভাব ছিল না।  তাই বাঙালির  সহজাত জ্ঞান ছিল যে মাছ সুপ্রাপ্য, মাছ সুস্বাধু , মাছ পুষ্টি দায়ক আর শিশুর জন্য মাছ পরিপূর্ণ খাবার। মাছ বাংলাদেশের সর্বত্র ছিল সহজলভ্য। নানা ধরণের মাছ, ছোট মাছ  অনেকটা যেন নিজে ধরা দিতো, মাছ আর কেবল শুধুমাত্র ভালো আর পুষ্টিকর খাবার থাকেনি, বাঙালীর ভালোবাসা আর গর্বের বিষয় হয়েছে। বাংলাদেশের সর্বত্র, অধিকাংশ পরিবারে মাছ সামাজিকতার অঙ্গ হয়েছে, আত্মীয়জন মাছ পরিবেশন না করলে মনক্ষুন্ন হয়েছে।  সব বাঙালিই ছোট বয়সে উপদেশ শুনেছে “মাছ খাও না হলে বড় হবে না” “মাছ খাও, মাথায় বুদ্ধি হবে” বা “এই মাছ খাও, পরীক্ষার ফল ভালো হবে” ।

আজকাল কিন্তু আর মাছ নিয়ে অত কথা শুনতে পাওয়া যায় না।  অবশ্যই এ বছর ইলিশ বেশি না কম হলো, এবার রপ্তানি হবে না আমদানি হবে; এরকম খবর দুচারটি খবরের কাগজে ছাপে।  কারণ এগুলো সব দামি মাছ। খবর গুলো হয়তো মাছ নিয়ে নয়, মাছের দাম নিয়ে। ঢাকা অথবা অন্যান্য শহরাঞ্চলে নতুন দারুণ খাবারের দোকান হয়েছে; দেশিবিদেশী নানাবিধ আয়োজনের খাবার পাওয়া যায়।  কিন্তু একটু ভালো মাছ-ভাত কোথায় পাওয়া যাবে, খুঁজতে হলে অনেকদিন অনেক পথে হাটঁতে হবে। যারা শহুরে  মধ্যবিত্ত, অথবা গ্রামাঞ্চলে উচ্চবিত্ত, তাদের অনেকের বাড়িতে বাচ্চারা দামি খাবার খায়, কিন্তু মাছ খাবে না।

অথচ বাংলাদেশের অসংখ্য শিশু অপুষ্টির শিকার। সরকার আর ইউনিসেফের নতুন রিপোর্ট " প্রগতির পথে বিবরণী " জানিয়েছে যে, পরিসংখ্যান মতে ৩০-৪০ শতাংশ শিশু এদেশে অপুষ্টিতে ভুগছে। কেবল গরিবের সন্তান নয়, মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে মেয়েরাও প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার আর পরিপালনের বাইরে। প্রশ্ন জাগে, চিরন্তন বিশ্বাস যে মাছ শিশুদের পুষ্টি যোগায়, তার থেকে আমরা দূরে সরে যাচ্ছি না তো? শিশু স্বাস্থ্যের সাথে জড়িত মায়েদের স্বাস্থ্য। মায়েরা মাছ খাচ্ছেন তো? এই সব ভাবনা চিন্তা নিয়ে বিশ্বব্যাংকের নতুন একটা গবেষণা প্রকাশিত হলো সম্প্রতি। বাংলাদেশে সামাজিক অর্থনৈতিক প্রসঙ্গে মাছ খাওয়া ও শিশু স্বাস্থ্য (The Socioeconomics of Fish Consumption and Child Health in Bangladesh)।

 বাংলাদেশের নিজস্ব জনসংখ্যাতাত্ত্বিক ও স্বাস্থ্য জরিপ (Demographic Health Survey) প্রায় প্রতি চার বছর পর হয়। এরকম ৫ টি জরিপের ( ২০০০, ২০০৪, ২০০৭, ২০১১ এবং ২০১৪ সাল) মোট ৩৬৪৯১ টি বর্ণনার সংখ্যাতাত্ত্বিক প্রতিলিপি (statistical regression) বিশ্লেষণ করা হয়েছে বিশ্বব্যাংকের এই গবেষণায়।  জানা যাচ্ছে যে, দেশের উন্নতির সাথে শিশু মৃত্যুর সংখ্যা কমেছে। পরিবারের আর্থিক উন্নতির সাথে শিশুর খাদ্য তালিকায় সর্ব মোট মাছ , মাংস আর  ডিমের অনুপাত বেড়েছে নজর কাড়ার মতো। কিন্তু আর্থিক উন্নতির সাথে মাছের  অনুপাত শিশুর খাদ্যে প্রত্যাশিত সমানুপাতে বাড়েনি।

গবেষণায় একটি অপ্রত্যাশিত ফল হলো যে পরিবারের প্রধানত: মায়েদের উচ্চশিক্ষার সাথে মাছ খাওয়ানোর প্রবণতা কমেছে। সব মিলিয়ে ডিম ও মাংসের তুলনায় বেশি পুষ্টিকর, উপকারী ও সস্তা হওয়া সত্ত্বেও, পারিবারিক ও আর্থিক সাচ্ছল্যের সাথে শিশুর খাবারে মাছের অনুপাত কমেছে। 

গবেষণাটি দেখিয়েছে যে, শিশু জন্মের আগে ও পরে মায়েরা একটু বেশি মাছ খেলে জন্মের প্রথম বছরে শিশুর মৃত্যুর আশংকা কমে যায়, আর জ্বর, কাশি, পেটের অসুখেও অপেক্ষেকৃত কম ভোগে শিশুরা।  বর্ষাকালে ও বর্ষার ঠিক পরে মাছ যখন সুলভ আর সহজপ্রাপ্য, তখন নিতান্ত নিম্নবিত্ত পরিবারের খাবারের তালিকায় অনুপাতে একটু বেশি হলেও স্থান পায় মাছ। ধারণা করা হচ্ছে এই সময়ে মায়েরাও মাছ খান। ফলত : বর্ষা অথবা তার একটু পরে সদ্যজাত বাচ্চাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এবং মৃত্যুহার কমে।  আর এর  উল্টো ঘটনা  ঘটে শুকনা মৌসুমে, যখন মাছ অতটা সহজ প্রাপ্য ও সুলভ হয় না। এবং মাছ খাওয়া কমে যায়।  সদ্যজাত শিশুদের রোগ বাড়ে, মৃত্যু হার বাড়ে।

বিশ্বব্যাংকের এই গবেষণার ফলাফল যেন কিছুটা ভুলে যাওয়া ঐতিহ্য মনে করিয়ে দেবার প্রচেষ্টা। শিশু স্বাস্থ্যের খাতিরে মাছের যোগান বাড়াতে হবে। বিশেষত: শিক্ষিত মায়েদের মাতৃ মঙ্গল শিক্ষায় জানাতে হবে মাছ খাওয়া কত প্রয়োজন। কেবল শিশুর খাবার নয়, অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের বছর ধরে খেতে হবে আরো একটু বেশী মাছ। গবেষণাটি আশা করে যে শিশুর অপুষ্টির অন্যতম সমাধান হবে বাঙ্গালীর চির পরিচিত মাছে ভাতে। আর ভাবতে ভালো লাগে যে সবার প্রার্থনা যেন হয়, কেবল সন্তান নয়, জননীরাও যেন সবাই থাকেন মাছে - ভাতে। 

 
ডেভিড হুইলার , সুস্মিতা দাশগুপ্ত, তাপস পাল , গোলাম মোস্তফা      


Authors

Susmita Dasgupta

Lead Environmental Economist, Development Research Goup, World Bank

Join the Conversation

The content of this field is kept private and will not be shown publicly
Remaining characters: 1000